ডক্টর পদবির তাৎপর্য"(Doctors Prefix)
যদিও আমি ঐ পর্যায়ের কেউ না, তবুও বর্তমান কিছু ঘটনার প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে আমার শিক্ষাগুরু আর মেধাবী ভাইদের মর্যদার কথা চিন্তা করে এসব কথা লিখতে হচ্ছে। পুরো আলোচনায় থাকছে কারা নামের আগে ডক্টর ব্যবহার করতে পারবেন কারা পারবেন না এবং এদেশে এর অপব্যবহার নিয়ে।
প্রথমে আসি কারা নামের আগে ডক্টর ব্যবহার করতে পারবেন। সোজা কথায় উত্তর দিলে যাদের ডিগ্রির নামের সাথে ডক্টর শব্দটি যুক্ত আছে শুধুমাত্র তারাই নামের সাথে ডক্টর পদবি ব্যবহার করতে পারবেন। দেখা যাক সে ডিগ্রি গুলো কি কি ধরনের হতে পারে।
১. পোস্ট-গ্রাজুয়েট রিসার্চ ডিগ্রি যে ডিগ্রির নামের সাথে ডক্টর শব্দটি যুক্ত আছে। যার সবচেয়ে কমন উদাহরণ পিএইচ ডি (Doctor of Philosophy)।
২. সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি। যেমন ১৯৩৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কে দেয়া ডি লিট (Doctor of Letters) ডিগ্রি।
৩. বিভিন্ন প্রফেশনালদের গ্রাজুয়েট/ পোস্ট-গ্রাজুয়েট/ রিসার্চ ডিগ্রি যে ডিগ্রির নামের সাথে ডক্টর শব্দটি যুক্ত আছে। যেমন চিকিৎসকদের এম.ডি (Doctor of Medicine), ডি.এস বা ডি.সার্জ (Doctor of Surgery)। ফার্মাসিস্টদের পোস্ট ব্যাচেলরেট ফার্ম.ডি (Doctor of Pharmacy)। আইনজীবীদের জে.ডি (Doctor of Jurisprudence)।
৪. এমন আন্ডারগ্রাজুয়েট ডিগ্রি যার নামের সাথে ডক্টর শব্দটি যুক্ত আছে। যেমনঃ প্রাণী চিকিৎসকদের ডিভিএম (Doctor of Veterinary Medicine), এটি বাংলাদেশেও প্রচলিত আছে। বিভিন্ন দেশে চিকিৎসকদের এমডি (Doctor of Medicine) এবং ফার্মাসিস্টদের ফার্ম.ডি (Doctor of Pharmacy) আন্ডারগ্রাজুয়েট হিসেবে পড়ানো হয়।
এমন আরো কিছু ডিগ্রির মধ্যে; ডিডিএস (Doctor of Dental Surgery), ডিবিএ (Doctor of Business Administration), ডিএনপি (Doctor of Nursing Practice), এড.ডি (Doctor of Education), ডি.ম্যান (Doctor of Management), ডি.মিউজ (Doctor Music), ডি.ইঞ্জি (Doctor of Engineering), এল.এল.ডি (Doctor of Law), ডিএফএ (Doctor of Fine Arts) সহ এমন আরো অনেক ডিগ্রি যাদের ডিগ্রির নামের সাথে ডক্টর শব্দটি যুক্ত আছে।
এখন হয়তো মনে প্রশ্ন জেগেছে তাহলে এমবিবিএস আর বিডিএস করা চিকিৎসক আর দন্ত চিকিৎসকগণ কি নামের আগে ডক্টর লিখতে পারবেন না! সোজা কথায় উত্তর "না"। কারন এমবিবিএস (Bachelor of Medicine Bachelor of Surgery), বিডিএস (Bachelor of Dental Surgery) দুটোই ব্যাচেলর ডিগ্রি। এমবিবিএস/বিডিএস এর সাথে যদি এমএস, এএফসিপিএস, এফআরসিএস, এমআরসিএস, এমআরসিপি, পিজিটি, এমপিএইচ, এম.ফিল এর মতো বড় ডিগ্রি থাকে তাহলেও পারবে না। তবে এম.ডি, ডি.সার্জ/ডি.এস, ডিডিএস, পিএইচডি বা ডক্টরেট করা থাকলে নামের আগে অবশ্যই ডক্টর লিখতে পারবে।
এবার আসি ফিজিওথেরাপি, হোমিওপ্যাথি, ইউনানি, আয়ুর্বেদ চিকিৎসকদের ব্যাপারে; ঐ একই কথা ডিগ্রির নামের সাথে ডক্টর শব্দটি যুক্ত থাকতে হবে। যারা শুধুমাত্র বিইউএমএস, বিএইচএমএস, বিএএমএস, বা বিপিটি নামের ডিগ্রি নিয়েছেন তারা পারবেন না। তবে বিভিন্ন দেশে এদের প্রত্যেক ডিসিপ্লিনের এমডি (Doctor of Medicine), ডিপিটি (Doctor of Physiotherapy), ডক্টরাল রিসার্চ বা ডক্টরেট ডিগ্রির ব্যবস্থা আছে।
এবার আসি মেডিকেল ফ্যাকাল্টি, মেডিকেল টেকনোলজি, ডেন্টান টেকনোলজি, হোমিওপ্যাথি, আয়ুর্বেদ, ইউনানি, ফার্মেসী বিষয়ে ডিপ্লোমা সহ স্বাস্থ্য বা চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট ডিপ্লোমা কোর্স সম্পন্ন করা ব্যক্তি দের কথা; এরা আরো আগে পারবে না। ব্যাচেলর ডিগ্রি কমপ্লিট করেই পারছে না, ডিপ্লোমাদের প্রশ্নই আসে না৷
এবার আসি এলএমএফ-পল্লি চিকিৎসক, ছয় মাসের ফার্মেসি সার্টিফিকেট কোর্স সম্পন্ন করা ডিসপেনসার বা ঔষধের দোকানদারের কথায়। চিকিৎসা প্রসঙ্গে আলোচনায় এরা চলে আসলেও এ বিষয়ে আলোচনা করা খুবই হাস্যকর হবে। তাই এদের ব্যপারে আলোচনাটা কেমন হতে পারে একটু কষ্ট করে বুঝে নিয়েন!
এবার আসি বিএমডিসি নামক একটি পেশাজীবি কাউন্সিলের জারিকৃত আইন; কারা নামের আগে ডক্টর/ডাক্তার লিখতে পারবেন কারা পারবেন না এই বিষয়ে একটি নির্দেশনা দেয়। তাদের এ আইনে অনুযায়ী "শুধুমাত্র এমবিবিএস ও বিডিএস ডিগ্রীধারী রেজিস্টার্ড চিকিৎসারাই নামে আগে ডক্টর লিখতে পারবেন"। যদিও বিএমডিসি নামক প্রতিষ্ঠান একটি পেশাজীবি কাউন্সিল আইন জারি করা বা শুধুমাত্র ব্যাচেলর ডিগ্রি করা দের নামের আগে ডক্টর লিখতে অনুমতি দেয়ার এরা কেউ না। (আমার কাছে মনে হয়েছে এদের এই আইনের মাধ্যমে ভারতের পশ্চিম উপকূলের সমুদ্র সৈকতে ডক্টরেট ডিগ্রি মুখ থুবড়ে পড়েছে।) আসলেই এদেশের চিকিৎসকদের ধৃষ্টতা অবাক করার মতো। বিএমডিসি নামের পেশাজীবি কাউন্সিল যদি তাদের ব্যাচেলর ডিগ্রি প্রাপ্তদের নামের সাথে ডক্টর জুড়ে দিতে পারে তাহলে সকল পেশাজীবি কাউন্সিলই তাদের গ্রাজুয়েটদের নামের সাথে ডক্টর পদবি ব্যবহারের অনুমতি দিতে পারে। যদিও হোমিওপ্যাথি, ফিজিওথেরাপি সহ অন্যান্যরা তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকায় এই তাদের কে এই ধরনের তথাকথিত আইনের আওতায় আনতে ব্যর্থ হয়েছে বিএমডিসি। এমনকি এর মাধ্যমে তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ডিপ্লোমা ইন মেডিকেল ফ্যাকাল্টি বা স্যাকমো কমিউনিটি কে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছে এই পেশাজীবি কাউন্সিল। তারা আদালতের দারস্থ হলে আদালত এই মনগড়া আইনের স্থগিতাদেশ দেয়। ফলে ডিপ্লোমা চিকিৎসকরাও ডক্টর টাইটেল ব্যবহার অব্যাহত থাকে। তবে বিএমডিসি এই ব্যপারে আইনানুগ ভাবে এগুতে পারেনি কারণ বিষয়টি আসলে তাদের পক্ষে নেউ চিকিৎসক কমিউনিটির জ্ঞানীগণ এটা ভালো করেই বোঝেন। এতেই প্রমাণিত হয়েছে যে, বিএমডিসির এই নির্দেশনা ভিত্তিহীন বা সহজ ভাষায় ভুয়াও বলা যায়। এমবিবিএস/বিডিএস ডিগ্রিপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা যে যুক্তিতে ডক্টর পদবি ব্যবহার করবেন ঠিকই একই যুক্তিতে ডিপ্লোমা থেকে এলএমএএফ-সার্টিফিকেট কোর্স সম্পন্নকারী এমন কি রাস্তায় রাস্তায় দাতের চিকিৎসা দেয়া বেদনীরাও নামের আগে ডাক্তার/ডক্টর ব্যবহার করতে পারাটা যুক্তিযুক্ত। কারন তারাও চিকিৎসা দেয়। তবে এই ভিত্তিহীন দাবির ব্যপারে চিকিৎসকগণ খুবই দূর্বল যুক্তি নিয়ে বরাবরই পেশিশক্তি আর চোয়ালের জোর প্রদর্শনের চেষ্টা করেছে।
আসলে ডক্টর শব্দটির বহুলভাবে ভুল ব্যবহার এধরণের কনফিউশান তৈরির প্রধান কারন। চিকিৎসকদের যে ডাক্তার বা ডক্টর বলা হয় সত্যিকার অর্থে শব্দটি এক্ষেত্রে ভুলভাবে ব্যবহার হয়। এদের ডাক্তার বা ডক্টর না বলে বাংলায় চিকিৎসক ইংরেজিতে ফিজিশিয়ান/সার্জন আর দন্ত চিকিৎসকদের ডেন্টিস্ট বলা যেতে পারে।
আসলে বাংলায় ডাক্তার শব্দটির উৎপত্তি ইংরেজি ডক্টর থেকেই। ডাক্তার শব্দটি মূলতঃ ইংরেজি ডক্টর (Doctor) শব্দের পরিবর্তিত উচ্চারণ। ইংরেজিতে ডক্টর (Doctor) শব্দটি এসেছে একই বানান এবং উচ্চারণের ল্যাটিন শব্দ ডক্টর (Doctor) থেকে। শব্দটি প্রকৃতপক্ষে ল্যাটিন ক্রিয়াপদ দোচিরি (Docēre) [উচ্চারণটি গুগল ট্রান্সলেট থেকে নেয়া] এর বিশেষ্য রূপ। দোচিরি (Docēre) শব্দটির অর্থ "To Teach" বা শিক্ষা দেওয়া। আবার উইলিয়াম হুইটাকার এর মতে, "ডক্টর এমন শিক্ষায়তনিক উপাধি যা একই রকম বানান এবং একইরকম অর্থ লাতিন শব্দ থেকে উদ্ভূত৷" শব্দটি মূলত লাতিন ক্রিয়া "ডকরে" [dɔˈkeːrɛ] (যার মানে - শেখানোর জন্য') এর একটি অভিজাত বিশেষ্য। আবার ভার্জার জে. (১৯৯৯) বলেন, ডক্টরেট (লাতিন: doceō, lit. অর্থ 'আমি পড়াই') মধ্যযুগীয় ইউরোপে একটি মধ্যযুগীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর লাইসেন্স হিসাবে উৎপত্তি হয়েছিল।
ব্যুৎপত্তিগত ভাবেই ডক্টর (Doctor) আসলে একটি অ্যাকাডেমিক টাইটেল এবং বর্তমানেও সমগ্র বিশ্বে সেই ব্যবহার প্রচলিত আছে। এর সাথে চিকিৎসক বা চিকিৎসার সম্পর্ক নেই। একাডেমিক টাইটেল হিসেবে ডক্টর শব্দটির যেমন স্ট্রং লজিক আছে, চিকিৎসকদের টাইটেল হিসেবে এর যুক্তি জিরো বললেই চলে।
ডক্টর বা ডাক্তার টাইটেলের এমন ঢালাও ব্যবহার বন্ধ করা উচিৎ। বিশেষ করে মেডিকেল সেক্টরে এর অপব্যবহারের লাগাম টেনে ধরা উচিৎ। তাদের পেশাজীবি কাউন্সিলের এমন তথাকথিত আইনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা অতিব জরুরি। চিকিৎসকদের টাইটেল হিসেবে ডক্টর/ডাক্তার শব্দটির ব্যবহার নিষিদ্ধ করে একাডেমিক টাইটেল হিসেবে এর সংরক্ষণ করে, যারা এই টাইটেলের প্রকৃত দাবিদার তাদের যথাযথ সম্মান প্রদর্শন এখন গুরুত্বপূর্ণ।
বিঃদ্রঃ লেখাটি -আবরার ভাই নামে একজন ভাইয়ের থেকে নেওয়া।
0 comments:
Post a Comment
Thanks for comment. We will response as soon as possible.Stay with us. Happy journey.!